মুখোমুখি
-রীণা চ্যাটার্জী
“দু’জনে মুখোমুখি কতো যে সুখী…” ধুর ধুর স্রেফ বাজে কথা। মুখোমুখি বসে সুখী! হয় না, হওয়া যায় না। আচ্ছা প্রথম মুখোমুখি বসার কথাই ধরি না হয়। সেই যে প্রথম দিন বসালো ঘেঁটি ধরে নাছোড় অভিভাবকরা পাত্রপক্ষের সামনে এনে, আড়চোখে দেখি বাবুমশায় মাথা নীচু করে ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করছে। বুঝলাম ষোলো আনার ইচ্ছেয় আঠেরো আনা লাগাম। বাবা- মায়ের বাধ্য সন্তান। ঠিক বুঝতে পারলাম না বশে রাখা যাবে, না কি বাধ্য সন্তান হয়েই থাকবে আজীবন। লাভ-ক্ষতি যাই হোক, জীবনে তো রিস্ক নিতেই হয়, দোনামনা করে আর একবার মুখোমুখি বসলাম- সোজা বিয়ের পিঁড়িতে। হাতে হাত- সম্প্রদানের মন্ত্র.. একবার তাকালোও না সামনে বসে থেকে। মনে মনে ভাবলাম, ধুর ছাতা কি ভীতু মাল রে বাবা! কিসের মুখোমুখি? কোথায় সুখ!
হাল ছাড়লাম না, এরপর শুভদৃষ্টির সময় এলো, চোখ তুলে তাকালো এবার, একদম মুখোমুখি। বেশ একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো। উঁহু, সুখ তো মালুম পেলাম না, আচ্ছন্ন ভাব কেমন যেন। একে কি সুখ বলে? কে জানে?
আবার মুখোমুখি- পাশাপাশি সব কিছুই হলো কিন্তু সামনে যজ্ঞের আগুন, সিঁদুর দান। আগুনে ঝলসাবো না কি সুখ খুঁজবো? অটোর পেছনের লেখা তখন চোখের সামনে, ‘সুখ সপনে (স্বপ্নে) শান্তি শশ্মানে’- সুখ খুঁজেই পেলাম না, তো সুখী হওয়া!
বাসর ঘর- এবার পাশাপাশি। চোখাচোখি হলো বার কয়েক। কিন্তু ওই যে বলে না শত্রু, বন্ধু’র মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। চোখাচোখি আমাদের হলেই ওদের গলায় খুশখুশে কাশি আসছে। কেন রে বাবা! এতো শত্রুতা কিসের তোদের বুঝলাম না! রাত কেটে গেল, ভোর হয়ে এলো। কোথায় সুখ?
আবার একবার মুখোমুখি- একেবারে ফুলের আসরে। বেশ সুখী সুখী পরিবেশ। ভাবলাম দেখি যদি মুখোমুখি বসে সুখী হওয়া যায়। খুব বেশী অপেক্ষা করতে অবশ্য হলো না। আত্মীয়, বন্ধুদের সাথে প্রবেশ করলেন। ওনারা কিছুটা জ্ঞান ঝেরেই চলেছেন, আর আমি ভেবেই চলেছি কতোক্ষণে ফাঁকা হবে, আর মুখোমুখি বসা যাবে। স্ত্রী-আচার, বাক্য- বিলাপ, হাসি- মস্করা সেরে অনিচ্ছুক পায়ে ঘর ছেড়ে বেরোলেন সবাই। যাক বাবা বাঁচা গেল। উনি দরজা বন্ধ করছেন। আমি মনে মনে একদম প্রস্তুত হয়ে বসলাম, মনে বড়ো আশা। এবার দু’জনে শুধু মুখোমুখি.. সুখ ধরা দেবেই, পালাবার আর পথ পাবে না।
কি আর বলি, মুখোমুখি বসলেন- ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে ফিসফিস আওয়াজ কানে এলো। এখানেও শত্রুতা! আড়ি পাতছে বোধহয় এতোক্ষণ যাঁরা ঘরে জ্বালাছিলেন তাঁরা। উনি উঠলেন.. খুব সন্তর্পণে আলোটা নিভিয়ে দিলেন। মুখোমুখি বসা? অন্ধকারে? নাহ্, সে গুড়ে বালি। বসা হলো না, তো সুখী হওয়া!
মুখোমুখি বসার ইচ্ছেটা মরে নি, তখনো মনে গেঁথে আছে। সুখী হওয়ার আশা কেই বা ছাড়তে পারে! তাই আমিও আশা ছাড়ি নি, চেষ্টাও করলাম বিয়ের পরে বেশ কয়েকবার মুখোমুখি বসার। আনাচ- কানাচে, আড়ালে- আবডালে, কিন্তু বিধি বাম। ছেলের ওপর মায়ের যা সতর্ক, কড়া দৃষ্টি! কোনোরকমে মুখোমুখি হলেই মিছরির ছুড়ি ঠিক কেটে দেবে সুখের জাল। সুখ কোথায়?
এরপর তো প্রয়োজনে জীবনে অনেকবার মুখোমুখি বসা হলো। কিন্তু সুখ? যতোবারই বসলাম দেখি একটা একটা বিপত্তি। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া- মুখোমুখি হিসাবে বসা কি করলে ভালো হয়। বলা বাহুল্য মতের মিল হয়নি। উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু। চুম্বকের রীতি মেনে দুই মেরুর আকর্ষণে সংসারে জুড়ে থাকা। সুখ কোথায়?
মেয়ের বিয়ে- আবার মুখোমুখি। বাজেট.. চিন্তা। সবার অলক্ষ্যে চোখে চোখে ইশারা, উদ্বেগ সব যেন ঠিক করে মিটে যায়, ভুল ত্রুটি না থাকে। মান- সম্ভ্রম, দায়- দায়িত্ব রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তখন দুই জোড়া চোখের দৃষ্টির মিলনে। সব কিছু ভালোভাবে মেটানোর জন্য কতোবার মুখোমুখি বসা হলো উৎকণ্ঠা আর মন খারাপের গল্প নিয়ে। কিন্তু সুখ কোথায়?
আস্তে আস্তে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, এখন আর মুখোমুখি বসার উপায় নেই, সম্ভবও নয়। ঘরে ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি। মনের ইচ্ছে মনেই থেকে গেল মনে হয় এই জীবনে- জলাঞ্জলি দিয়ে দিলাম একরকম মুখোমুখি বসার ইচ্ছেটাকে।
আজ সকাল থেকে সব কিছু অন্যরকম লাগছে। অনেকগুলো মুখের ভিড় আমার চারপাশে। আরে এ কি দেখি? যার সাথে সারাজীবন মুখোমুখি বসার স্বপ্ন দেখলাম- সুখ খূঁজবো বলে সে যে একদম মুখোমুখি বসে আছে। কিন্তু অমন ভাবে তাকিয়ে কেন? চোখের কোনে জল যেন মনে হচ্ছে! কেন? কিন্তু মুখোমুখি বসেও সুখ মালুম হচ্ছে না কেন? অনেকক্ষণ এইভাবে যখন কেটে গেল, শুনি আশেপাশে সবাই বলছে এবার বডি নিয়ে গেলে ভালো হয়, অনেকক্ষণ তো হলো। বুঝতে পারলাম, আর মানুষ নেই, বডি হয়ে গেছি। কি হলো? কি যেন পড়লো! দেখি, দু’ ফোঁটা তপ্ত অশ্রু পড়লো আমার হিম ঠাণ্ডা কপালে। একটা অদ্ভুত অনুভুতি হলো, কেঁপে উঠলো সমস্ত অন্তর আত্মা, দুলে উঠলো পৃথিবী… আমার মুখোমুখি বসে আমার জন্য চোখে জল! অতৃপ্ত মন মুখোমুখি বসার তৃপ্তির সাধে গুনগুন করে উঠলো, ‘দু’জনে মুখোমুখি কত যে সুখী.. ফুরাবে সব হাসি ক্রন্দনে, এতো ভাবতেও পারি….” ভাবার আর অবকাশ দিলো কোথায় সময়… মানুষের জন্য সময় থাকে না, এখন তো বডি.. কত আর সময় থাকে? ভাবার সময় নেই, ভাবতে দেবার সময় নেই।
পরিচিত, প্রিয় মুখটা আস্তে আস্তে সামনে থাকে সরে যাচ্ছে, শুনতে পেলাম কোরাসের, ‘বলো হরি, হরিইই বলল….
প্রতিটা স্টেপ দারুন ভাবে সহজ ভাষায় তুলে ধরলেন দিদি ।খুব সুন্দর লেখাটা পরে আদ্যন্ত মজা পেলাম।
প্রাপ্তি ভাই
বাহঃ বেশ লাগলো
ধন্যবাদ 🙏